সৌদিতে ক্লিনার-লোডার পেশায়ও সনদ বাধ্যতামূলক: হাজারো বাংলাদেশি কর্মীর ভিসা জট

স্বল্প দক্ষতার পদে ‘স্কিল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম’ (এসভিপি) বাধ্যতামূলক হওয়ায় ভিসা ইস্যু বন্ধ; জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিপাকে

ঢাকা, বাংলাদেশ – বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে এখন ক্লিনার ও লোডিং-আনলোডিংয়ের মতো স্বল্প দক্ষতার পেশাতেও চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সৌদি সরকার এসব খাতেও তাদের ‘স্কিল ভেরিফিকেশন প্রোগ্রাম’ (এসভিপি) সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। এর ফলে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মীর ভিসা আটকে আছে এবং সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এই নতুন বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল শ্রমবাজারকে সংকুচিত করতে পারে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া মোট কর্মীদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই এই দুই পেশায় নিযুক্ত হন। সম্প্রতি ঢাকার সৌদি দূতাবাস এসভিপি সনদ ছাড়া এসব পেশায় কর্মী নিয়োগের জন্য ভিসা ইস্যু করা বন্ধ করে দিয়েছে, যা একটি বড় ভিসা জটের সৃষ্টি করেছে।

এসভিপি: নতুন নিয়ম, পুরাতন মজুরি

২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরব প্রথম পাঁচটি খাতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে এসভিপি চালু করে। গত দুই বছরে এর পরিধি বেড়ে ৭১টি পেশায় দাঁড়িয়েছে এবং বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, এটি শিগগিরই ৭৩টিতে পৌঁছাতে পারে। নতুন করে ক্লিনার ও লোডার (লোডিং-আনলোডিং) পেশাও এর আওতায় আসায় উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

যদিও স্বল্পদক্ষ পেশাগুলোতে কর্মসংস্থানের জন্য এসভিপি সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, কিন্তু এর সঙ্গে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। ফলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও অভিবাসী অধিকারকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে, বর্তমানে সৌদি আরবে ৩০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন।

ভিসা জট ও সাময়িক শিথিলতা

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) সূত্র জানায়, আকস্মিকভাবে এসভিপি সনদ বাধ্যতামূলক করার কারণে বর্তমানে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসে আনুমানিক ৮০ থেকে ৯০ হাজার ভিসার আবেদন আটকে আছে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে সৌদি গমনকারী কর্মীর সংখ্যা মে মাসের তুলনায় ৫ হাজারের মতো কমে ৬৪ হাজার ৫০৪ জনে দাঁড়িয়েছে।

তবে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সৌদি দূতাবাস লোডিং-আনলোডিং পেশার ক্ষেত্রে আগামী ২০ জুলাই পর্যন্ত এসভিপি সনদ দেখানোর নিয়ম শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, ক্লিনার পেশার ক্ষেত্রে আরও কয়েক মাসের ছাড় দেওয়া হতে পারে। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ইতোমধ্যে ক্লিনার ও লোডার-আনলোডারদের জন্য বাধ্যতামূলক সনদ শিথিল করতে সৌদি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন।

খাত সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ

বিএমইটির ট্রেনিং অপারেশনের পরিচালক মো. সালাহ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ফেস করছি লোডিং-আনলোডিং এবং ক্লিনার ট্রেড নিয়ে। নতুন করে এই দু’টিকে তাকামুলে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, হঠাৎ করে ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিপদে পড়েছে, কারণ অ্যাসেসমেন্ট ছাড়া কর্মীরা আর যেতে পারবেন না।

সালাহ উদ্দিন আরও বলেন, “আমরাও চাই না ক্লিনার বা লোডার-আনলোডারদের জন্য সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হোক। সার্টিফিকেশন ভালো উদ্যোগ হলেও এভাবে চললে সব শ্রেণির লোকেরা আর যেতে পারবে না। কারণ পরীক্ষা দিলে সবাই পাশ করতে পারবে না, ফলে বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে।” তিনি ক্লিনার ও লোডারদের জন্য কম্পিউটার পরীক্ষা বাদ দিয়ে শুধু ব্যবহারিক পরীক্ষার ভিত্তিতে সনদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন, যা তাদের জন্য অধিকতর বাস্তবসম্মত হবে।

ফ্রিডম ওভারসিজের মালিক কাফিল উদ্দিন মজুমদার বলেন, “যারা সাধারণ কর্মী ভিসায় যান, তাদের বেশিরভাগই ক্লিনিং বা লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ করেন। আমাদের দাবি ছিল, ক্লিনার এবং লোডিং-আনলোডিং ট্রেডগুলো ট্রেনিংয়ের আওতার বাইরে রাখা। কিন্তু হঠাৎ করেই এগুলোকে সেই আওতায় আনা হয়েছে।” তিনি জানান, অনেক কর্মীর ভিসা প্রক্রিয়াধীন থাকলেও তারা ট্রেনিং করেননি, যার ফলে তাদের মেডিকেল রিপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

বিএমইটির প্রস্তুতি ও পরীক্ষার প্রক্রিয়া

এসভিপি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে লোডিং-আনলোডিং ট্রেডে স্কিল যাচাই পরীক্ষার আয়োজন শুরু করেছে বিএমইটি। বর্তমানে দেশের নয়টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (টিটিসি) এই পরীক্ষা চলছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদন দিলে এটি আরও ২০টি টিটিসিতে সম্প্রসারণ করা হবে।

বিএমইটির ট্রেনিং অপারেশন পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. সালাহ উদ্দিন জানান, তাদের লক্ষ্য হলো প্রতি মাসে লোড-আনলোড ট্রেডে ৩০,০০০ জনকে এবং ক্লিনিং ট্রেডে ৫,০০০ জনকে মূল্যায়ন করা। অন্যান্য দক্ষতাসহ প্রতি মাসে মোট ৪০,০০০ কর্মীকে তাকামুলের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোট ২৭,০০০ জনকে এসভিপির আওতায় অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে, যার মধ্যে ২১,০০০ জন (প্রায় ৭৩%) উত্তীর্ণ হয়ে সৌদি আরবে গেছেন।

তাকামুল প্রক্রিয়ার আওতায়, কর্মীদের নিবন্ধনের পর অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একটি সনদ অর্জন করতে হয়। এজন্য ৫০ ডলার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়, যা কর্মীরা নিজেরাই বহন করছেন। এই পরীক্ষায় একাধিকবার অংশ নেওয়া যাবে এবং সনদ পাঁচ বছরের জন্য বৈধ থাকবে।

বেতন বৃদ্ধির দাবি

সৌদি আরব ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী, এসভিপি চালু হওয়ার পর সৌদি আরবে দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো সহজ হবে এবং এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশন চালু হলেও বাংলাদেশি কর্মীদের বেতন এখনও বাড়েনি বলে অভিযোগ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ক্লিনার ও নির্মাণশ্রমিকদের মতো স্বল্পদক্ষ কাজ করা শ্রমিকরা সৌদি আরবে সাধারণত মাসে ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা আয় করেন, যা এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, “এই সার্টিফিকেট দিয়ে আমাদের কর্মীদের কী লাভ হলো? একদিকে তাদের ফি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে বেতন কি বেড়েছে? যদি বেতন দ্বিগুণ হতো, তাহলে তা কিছুটা যৌক্তিক হতো।”

এ বিষয়ে বিএমইটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বেতন বাড়ানোর বিষয়ে সৌদি সরকারকে চাপ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, “যেহেতু কর্মীরা পাস করেই যাচ্ছেন, এখন আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।”

বর্তমানে সৌদি আরব ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন ও মালয়েশিয়ার মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কার্যত বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থায় সৌদি আরবে নতুন এই কঠোরতা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এক বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

 

Hot this week

spot_img

Related Articles

spot_imgspot_img