মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা— বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে মব ভায়োলেন্স
ঢাকা, ২৩ জুন:
বাংলাদেশে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ওপর প্রকাশ্য মব হামলার ঘটনার পর ‘মব ভায়োলেন্স’ বা গণ-সন্ত্রাস নিয়ে নতুন করে বিতর্ক র্তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশে এখন কার্যত ‘মবের মুল্লুক’ চলছে। প্রশাসনের সামনে একজন সাবেক সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিকে ঘিরে ঘন্টাখানেক ধরে অপমান-নির্যাতনের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে।
কি ঘটেছিল উত্তরায়?
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ের সিইসি কে এম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। কিন্তু এর আগেই উত্তরা এলাকায় তার বাসার সামনে একদল লোক তাকে প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করে, জুতাপেটা করে এবং ডিম ছুড়ে মারে। পুলিশ নিকটে উপস্থিত থাকলেও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ঘটনাটি ভিডিও আকারে ভাইরাল হয়।
‘মব’ হামলার নেপথ্যে রাজনীতি?
এই ঘটনায় সরকারপন্থী কেউ জড়িত কি না— এমন প্রশ্ন উঠলেও, বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলাটি করা হয়। একইদিনে বিএনপি থেকে সাবেক সিইসি-সহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল, যেখানে ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ এবং ‘রাতের ভোট’ আয়োজনের অভিযোগ আনা হয়।
সরকারি প্রতিক্রিয়া: বিবৃতি আছে, পদক্ষেপ নেই
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এক বিবৃতিতে বলে, “মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বেআইনি।” স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও বলেছেন, ঘটনার তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, এমনকি মামলাও হয়নি মব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
‘বিবৃতি দিলেই হবে না’: মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “বিবৃতি যথেষ্ট নয়, চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।”
এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন,
“সরকার ‘চুজ অ্যান্ড পিক’ নীতিতে চলেছে। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, তারা রয়ে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।”
সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন,
“আগে ছিল মগের মুল্লুক, এখন মবের মুল্লুক। সরকার প্রকারান্তরে একটি গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে।”
মব সন্ত্রাসের বিস্তৃতি: পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাও রেহাই পাচ্ছে না
এইচআরএসএস-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ২০২টি মব হামলায় ১৩১ জন নিহত, ১৬৫ জন আহত হয়েছেন।
আসক বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ৮৩টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
মব হামলার শিকার হয়েছেন—
- পুলিশ সদস্যরা (২২৫টি হামলা, ৭০টি বড় ধরনের)
- অভিনেতা সিদ্দিক, ভাস্কর রাসা
- এনসিপি বিরোধীদের বাড়িঘর
- পারিবারিক বিরোধে হিরো আলম ও তার স্ত্রীর বাড়িতে মব
- ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সেলুনকর্মী পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে
- বগুড়ায় কলেজ অধ্যক্ষ মিল্লাত হোসেন
সাবেক আইজিপি ও আইনজীবীদের মতামত
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন,
“একজন সাংবিধানিক পদে থাকা ব্যক্তিকে এইভাবে হেনস্তা মেনে নেয়া যায় না। পুলিশ চাইলে প্রতিরোধ করতে পারত।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন,
“বিবৃতির বাইরে কিছু হলে না, দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার।”
বিএনপির অবস্থান
সাবেক সিইসির ওপর হামলায় বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে শাস্তির কথা জানিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,
“আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না। আইন ও বিচারেই আমরা আস্থাশীল।”
উপসংহার: ভয় ও বিচারহীনতার দোলাচলে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে গণতন্ত্রোত্তর সময়ে ‘জনতার আদালত’ বা ‘মব জাস্টিস’ এক ভয়ংকর প্রবণতায় রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দায় নির্ধারণ না করে এই ধরনের জন-আক্রমণ, কোনো রাষ্ট্রের আইনের শাসনকে ব্যাহত করতে পারে বলেই আশঙ্কা তাদের।